গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর শেখ হাসিনা বিদেশ চলে গেলে তার মন্ত্রিসভার সদস্য ও দলের নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় সোমবার (১৯ আগস্ট) সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার হন সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি।
গত ১১ বছরে দীপু মনি পররাষ্ট্র, শিক্ষা এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশেষ করে শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হন। তার সময়ে শিক্ষা খাতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, যেখানে পাঁচটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে কুক্ষিগত করার অভিযোগ রয়েছে।
দীপু মনির দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে খোঁজ রাখেন এমন অনেকেই জানান, মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ পর্যন্ত তার দাপট ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের জন্য দুই কোটি টাকা এবং কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য ৫০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
তার সময়ে এসব দুর্নীতির তথ্য ছিল একটি ‘ওপেন সিক্রেট’। তার মন্ত্রণালয়ের সচিবরা এই অনিয়ম সম্পর্কে জানলেও ভয়ের কারণে প্রতিবাদ করতে পারেননি। এসব দুর্নীতির বিষয়টি ঢাকা পোস্টের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
দীপু মনির ক্ষমতায় থাকাকালে দুজন সচিবের সঙ্গে কথা বললে তারা এসব বিষয় জানলেও দীপু মনির প্রভাবের কারণে কোনো প্রতিবাদ করতে পারেননি। দীপু মনির ভাই ডা. জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ টিপুর মাধ্যমে সব নিয়োগ ও পদায়ন হতো। বিতর্কের কারণে একপর্যায়ে এক সচিব অন্যত্র চলে যান এবং দীপু মনির একান্ত সচিবও পদত্যাগ করেন।
শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে দীপু মনি তার ভাই টিপুর মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য কায়েম করেন। বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি এবং কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য দুর্নীতি প্রবণতা দেখা যায়। একজন ভিসি নিয়োগের জন্য দুই কোটি টাকা এবং একটি কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দিতে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হতো। শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পদ দুই লাখ থেকে ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হতো।
আওয়ামী লীগ সরকারের চার মেয়াদের মধ্যে তিন মেয়াদে ভিন্ন তিনটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন দীপু মনি। পররাষ্ট্র ও শিক্ষায় পূর্ণকালীন মেয়াদ শেষ করে তিনি সর্বশেষ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তিন মন্ত্রণালয়ে থাকার সময় দীপু মনি এবং তার ভাই টিপু অনেক বিতর্কের জন্ম দেন। তারা রাজধানীর কলাবাগান ও বনানীতে ছায়া অফিসের মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
১৪তম বিসিএসের এক কর্মকর্তা জানান, তাকে কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসতে ৫৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছিল। প্রথমে মন্ত্রীর ডিও লেটার নিয়ে গেলে শিক্ষামন্ত্রী আশ্বাস দেন, তবে পরে টিপুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। অন্য একটি মাধ্যমে ৫৫ লাখ টাকায় দফারফা হয়।
চট্টগ্রাম বিভাগের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদে পদায়নের জন্য দুই কোটি টাকা নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সুপারিশ আসার পর টিপু জানান, ভিসি হওয়ার জন্য দুই কোটি টাকা দিতে রাজি আছেন কয়েকজন। এরপর ওই ভিসি টাকা দিতে রাজি হন।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে আর্থিক লেনদেন হয়েছে। দীপু মনির সময়ে নিয়োগ বাণিজ্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, যা ইউজিসির কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।